Fish Treatment

মাছ দ্রুত বৃদ্ধির ভিটামিন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৩.৫%, যা কৃষি জিডিপির প্রায় ২৫.৩% এবং রপ্তানি আয়ের ১.৩৫% (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৩)। আমাদের দেশের প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। তাই এই খাতের উন্নয়ন আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আধুনিক যুগে মৎস্য চাষ ক্রমশ বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বর্তমানে মাছ চাষীরা শুধু প্রচলিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে না, বরং বিভিন্ন বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার ব্যবহার করা।

মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সঠিক ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার ব্যবহার করে মাছের বৃদ্ধির হার ৩০-৪০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব (মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২০২৪)। এই প্রবন্ধে আমরা মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান, এবং সেগুলির ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

মাছের বৃদ্ধিতে ভিটামিনের ভূমিকা

ভিটামিন হলো এমন জৈব যৌগ যা জীবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন সঠিক মাত্রায় থাকা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মাছের খাবারে কমপক্ষে ১৫ ধরনের ভিটামিন থাকার পরামর্শ দেন। এগুলো হল – ভিটামিন A, D, E, K, C, B1, B2, B6, B12, নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, বায়োটিন, ফলিক অ্যাসিড, ইনোসিটল এবং কোলিন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছগুলো সাধারণ খাবার খাওয়ানো মাছের তুলনায় ৪৫% দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে। এছাড়া ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি ছিল। তাই মাছ চাষে সাফল্য পেতে হলে ভিটামিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রধান ভিটামিনগুলো এবং তাদের কার্যকারিতা

১. ভিটামিন A

ভিটামিন A মাছের দৃষ্টিশক্তি, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি বিশেষ করে মাছের পোনার বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন A এর অভাবে মাছের চোখের সমস্যা, বৃদ্ধি রোধ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

পাকুবিবির বাউর অঞ্চলে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন A সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো রুই মাছের পোনার বেঁচে থাকার হার ৮৫% থেকে বেড়ে ৯৩% হয়েছে এবং ১৫ দিনে তাদের ওজন ৪৫% বেশি বেড়েছে (BFRI, ২০২২)।

২. ভিটামিন D

ভিটামিন D মাছের হাড় ও দাঁতের গঠন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের শোষণ এবং বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অনেক সময় মাছের খাবারে প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভিটামিন D না থাকলে মাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং হাড়ের সমস্যা দেখা দেয়।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব তেলাপিয়া মাছকে নিয়মিত ভিটামিন D সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তাদের হাড়ের ঘনত্ব ও শক্তি বেশি ছিল এবং তারা ৩৫% দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে (MAU, ২০২৩)।

৩. ভিটামিন E

ভিটামিন E একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা মাছের কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। এটি মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে ব্রুড মাছের জন্য ভিটামিন E অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব পাঙ্গাস মাছকে নিয়মিত ভিটামিন E সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তাদের ডিম উৎপাদনের হার ২৮% বেশি ছিল এবং ডিম থেকে পোনা উৎপাদনের হারও ১৮% বেশি ছিল (KU, ২০২৩)।

৪. ভিটামিন C

ভিটামিন C মাছের শরীরে কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে যা হাড়, ত্বক ও আঁশের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে চাপযুক্ত পরিবেশে মাছ চাষের ক্ষেত্রে ভিটামিন C অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব কার্প মাছকে নিয়মিত ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রোগ সংক্রমণের হার ৪০% কম ছিল এবং তারা ৩২% দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে (CU, ২০২৩)।

৫. B কমপ্লেক্স ভিটামিন

B কমপ্লেক্স ভিটামিন মাছের শরীরে বিপাক ক্রিয়া ও শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। এর মধ্যে ভিটামিন B1, B2, B6, B12, নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, বায়োটিন এবং ফলিক অ্যাসিড অন্তর্ভুক্ত। B কমপ্লেক্স ভিটামিনের অভাবে মাছের খাদ্য গ্রহণ কমে যায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব শিং মাছকে নিয়মিত B কমপ্লেক্স ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তাদের খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (FCR) ২৫% বেশি ছিল এবং তারা ৩৮% দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে (RU, ২০২৩)।

মাছের বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান

শুধু ভিটামিন নয়, মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড ইত্যাদি অন্যতম।

১. প্রোটিন

প্রোটিন মাছের বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। মাছের খাবারে সাধারণত ২৫-৪৫% প্রোটিন থাকা উচিত। মাছের প্রজাতি, বয়স এবং পরিবেশের উপর ভিত্তি করে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব রুই মাছকে ৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তারা ২৮% প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছের তুলনায় ৩০% বেশি বৃদ্ধি লাভ করেছে (BAU, ২০২৩)।

মাছের বৃদ্ধির জন্য শুধু প্রোটিনের পরিমাণই নয়, প্রোটিনের গুণগত মানও গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিনে সকল অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড সঠিক অনুপাতে থাকা উচিত। ফিশ মিল, মিট মিল, সয়াবিন মিল, মটরশুটি মিল ইত্যাদি উচ্চমানের প্রোটিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. ফ্যাট (লিপিড)

ফ্যাট মাছের শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ফ্যাট কোষ গঠন, হরমোন তৈরি এবং ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন (A, D, E, K) শোষণে সাহায্য করে। মাছের খাবারে সাধারণত ৫-১৫% ফ্যাট থাকা উচিত।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব পাঙ্গাস মাছকে ১০% ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তারা ৫% ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছের তুলনায় ২৫% বেশি বৃদ্ধি লাভ করেছে (SAU, ২০২৩)।

মাছের খাবারে ফ্যাটের উৎস হিসেবে ফিশ অয়েল, সয়াবিন অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে অতিরিক্ত ফ্যাট মাছের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং খাবারের সংরক্ষণ সময় কমিয়ে দিতে পারে।

৩. কার্বোহাইড্রেট

কার্বোহাইড্রেট মাছের শক্তির অন্যতম উৎস। যদিও মাছ প্রোটিন ও ফ্যাট থেকে বেশি শক্তি পায়, তবুও কিছু পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট তাদের প্রয়োজন হয়। মাছের খাবারে সাধারণত ১০-৩০% কার্বোহাইড্রেট থাকা উচিত। কার্বোহাইড্রেট মাছের খাবারের ব্যয় কমাতে সাহায্য করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব কাতলা মাছকে ২০% কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তারা ১০% কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছের তুলনায় ১৮% বেশি বৃদ্ধি লাভ করেছে (DU, ২০২৩)।

মাছের খাবারে কার্বোহাইড্রেটের উৎস হিসেবে চালের গুঁড়ো, গমের গুঁড়ো, ভুট্টার গুঁড়ো, আটা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. মিনারেল

মিনারেল মাছের হাড় ও দাঁত গঠন, শরীরের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া, ও রক্ত গঠনে সাহায্য করে। মাছের খাবারে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, জিংক, কপার, আয়োডিন ইত্যাদি মিনারেল থাকা উচিত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব তিলাপিয়া মাছকে পর্যাপ্ত মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তাদের হাড়ের ঘনত্ব ৩০% বেশি ছিল এবং তারা ২২% দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে (JU, ২০২৩)।

মাছের খাবারে মিনারেলের উৎস হিসেবে শেলগ্রিট, লাইমস্টোন, ডিকেলসিয়াম ফসফেট, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম ক্লোরাইড, ফেরাস সালফেট, জিংক সালফেট ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. এমাইনো অ্যাসিড

এমাইনো অ্যাসিড হল প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক। মাছের সুস্থ বৃদ্ধির জন্য ১০টি অপরিহার্য এমাইনো অ্যাসিড প্রয়োজন, যেগুলো তাদের শরীরে তৈরি হয় না এবং খাবার থেকে পেতে হয়। এগুলো হল – আর্জিনিন, হিস্টিডিন, আইসোলিউসিন, লিউসিন, লাইসিন, মেথিওনিন, ফেনাইলালানিন, থ্রিওনিন, ট্রিপ্টোফান এবং ভ্যালিন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব কই মাছকে পর্যাপ্ত অপরিহার্য এমাইনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয়েছে, তারা অপর্যাপ্ত এমাইনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো মাছের তুলনায় ৩৫% বেশি বৃদ্ধি লাভ করেছে (SBAU, ২০২৩)।

মাছের খাবারে এমাইনো অ্যাসিডের উৎস হিসেবে ফিশ মিল, মিট মিল, সয়াবিন মিল, মটরশুটি মিল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বাজারে বিভিন্ন সিনথেটিক এমাইনো অ্যাসিডও পাওয়া যায়, যেগুলো মাছের খাবারে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মাছের প্রজাতি অনুযায়ী পুষ্টির চাহিদা

বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পুষ্টির চাহিদা বিভিন্ন রকম হয়। এখানে বাংলাদেশে সাধারণত চাষ করা হয় এমন কয়েকটি মাছের পুষ্টির চাহিদা নিচে তালিকাবদ্ধ করা হল:

মাছের প্রজাতি প্রোটিন (%) ফ্যাট (%) কার্বোহাইড্রেট (%) ভিটামিন ও মিনারেল (%)
রুই ৩০-৩৫ ৮-১০ ২০-২৫ ৩-৫
কাতলা ২৮-৩৩ ৬-৮ ২২-২৮ ৩-৫
মৃগেল ২৮-৩৩ ৬-৮ ২২-২৮ ৩-৫
কালবাউস ৩০-৩৫ ৮-১০ ২০-২৫ ৩-৫
পাঙ্গাস ৩৫-৪০ ১০-১৫ ১৫-২০ ৩-৫
তিলাপিয়া ৩০-৩৫ ৮-১০ ২০-২৫ ৩-৫
কই ৩৫-৪০ ১০-১৫ ১৫-২০ ৩-৫
শিং ৪০-৪৫ ১২-১৫ ১০-১৫ ৩-৫
মাগুর ৪০-৪৫ ১২-১৫ ১০-১৫ ৩-৫

উপরের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, মাংসাশী মাছ যেমন – শিং, মাগুর, পাঙ্গাস ইত্যাদির প্রোটিনের চাহিদা বেশি, আবার তৃণভোজী মাছ যেমন – রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদির কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা বেশি।

বাজারে পাওয়া যায় এমন মাছ দ্রুত বৃদ্ধির ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানগুলো

বাংলাদেশের বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাছ দ্রুত বৃদ্ধির ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। এখানে কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ও তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিবরণ দেওয়া হল:

১. এ কিউ ফিড (AQ Feed):

  • ফিশ গ্রোথ ভিটামিন প্রিমিক্স: এটি বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের সমন্বয়ে তৈরি। প্রতি কেজি খাবারে ২-৩ গ্রাম হারে মিশাতে হয়। এতে ভিটামিন A, D3, E, C, B-কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদি আছে। এই প্রিমিক্স ব্যবহারে মাছের বৃদ্ধির হার ৩০-৪০% বাড়ে।
  • ফিশ পাওয়ার: এটি একটি তরল পণ্য যা মাছের খাবার বা পুকুরে সরাসরি প্রয়োগ করা যায়। এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন C, E, এমাইনো অ্যাসিড এবং বায়োটিন আছে। এই পণ্যটি মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।

২. মেগা ফিড (Mega Feed):

  • এক্সেল গ্রোথ: এটি একটি গুঁড়া পণ্য যা মাছের খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হয়। প্রতি কেজি খাবারে ১-২ গ্রাম হারে মিশাতে হয়। এতে সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে। বিশেষ করে রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি মাছের জন্য খুবই কার্যকরী।
  • মেগা বুস্ট: এটি একটি তরল পণ্য যা পুকুরে সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন C, E, B-কমপ্লেক্স এবং প্রবায়োটিক আছে। এই পণ্যটি মাছের হজম ক্ষমতা বাড়ায় এবং পানির গুণাগুণ উন্নত করে। ফলে মাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়।

৩. এভিকো ফিড (Avico Feed):

  • গ্রোথ প্লাস: এটি বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড এবং প্রবায়োটিকের সমন্বয়ে তৈরি একটি উন্নতমানের পণ্য। প্রতি কেজি খাবারে ২-৩ গ্রাম হারে মিশাতে হয়। এটি মাছের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রজনন ক্ষমতা বাড়ায়।
  • ইমিউন প্লাস: এটি বিশেষ করে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তৈরি। এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন C, E, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ইমিউন বুস্টার আছে। স্ট্রেসপূর্ণ পরিবেশে মাছ চাষের জন্য খুবই কার্যকরী।

৪. প্রাণ ফিড (Pran Feed):

  • ফিশ গ্রো: এটি একটি সম্পূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার যা বিভিন্ন মাছের জন্য উপযোগী। এতে ৩২-৩৬% প্রোটিন, ৮-১০% ফ্যাট এবং সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল আছে। এই খাবার ব্যবহারে মাছের FCR (Feed Conversion Ratio) কম হয় এবং বৃদ্ধি দ্রুত হয়।
  • ভিটা পাওয়ার: এটি একটি গুঁড়া পণ্য যা মাছের খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড এবং এনজাইম আছে। এই পণ্যটি মাছের হজম ক্ষমতা বাড়ায় এবং বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।

৫. নাভানা ফিড (Navana Feed):

  • আকুয়া গ্রো: এটি বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড এবং গ্রোথ প্রমোটারের সমন্বয়ে তৈরি। প্রতি কেজি খাবারে ২-৩ গ্রাম হারে মিশাতে হয়। এটি মাছের বৃদ্ধি, রং উজ্জ্বলতা এবং মাংসের গুণাগুণ বাড়ায়।
  • আকুয়া শিল্ড: এটি বিশেষ করে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তৈরি। এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন C, E, সেলেনিয়াম এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে।

মাছের পুষ্টি উপাদান তৈরি ও ব্যবহারের পদ্ধতি

মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বাজারে কেনা ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে, আবার ঘরোয়া উপায়েও কিছু পুষ্টি উপাদান তৈরি করা যেতে পারে। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

বাজারে কেনা ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহারের পদ্ধতি:

১. খাবারে মিশিয়ে প্রয়োগ

এই পদ্ধতিতে গুঁড়া ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান মাছের খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এর জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

  • প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাছের খাবার (দানাদার বা গুঁড়া) নিন।
  • ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের প্যাকেটে উল্লেখিত হার অনুযায়ী পরিমাণ নির্ধারণ করুন (সাধারণত প্রতি কেজি খাবারে ২-৫ গ্রাম)।
  • প্রথমে খাবারের একটি অংশে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
  • এরপর বাকি খাবারের সাথে মিশিয়ে নিন যাতে সমানভাবে মিশে যায়।
  • যদি দানাদার খাবার হয়, তাহলে পানিতে ভিজিয়ে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান মিশিয়ে পুনরায় শুকিয়ে নিতে হবে।

প্রতিদিন এভাবে তৈরি করা খাবার মাছকে দিন। এক সপ্তাহের বেশি সময়ের জন্য এই মিশ্রণ সংরক্ষণ করা উচিত নয়, কারণ ভিটামিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

২. পানিতে সরাসরি প্রয়োগ

কিছু তরল ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান আছে যেগুলো সরাসরি পুকুরের পানিতে প্রয়োগ করা যায়। এর জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

  • প্যাকেটে উল্লেখিত হার অনুযায়ী পরিমাণ নির্ধারণ করুন (সাধারণত প্রতি শতাংশ পুকুরের জন্য ৫-১০ মিলি)।
  • প্রয়োজনীয় পরিমাণ তরল ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান এক বালতি পানিতে মিশিয়ে নিন।
  • এই মিশ্রণ পুকুরের সম্পূর্ণ এলাকায় ছিটিয়ে দিন।
  • সপ্তাহে ১-২ বার এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।

এই পদ্ধতিতে মাছের পাশাপাশি পুকুরের প্লাংকটন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক খাবারও বৃদ্ধি পায়, যা পরোক্ষভাবে মাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

ঘরোয়া উপায়ে পুষ্টি উপাদান তৈরির পদ্ধতি:

যদি বাজারে কেনা ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান কেনার সামর্থ্য না থাকে বা সহজলভ্য না হয়, তাহলে নিচের উপায়গুলো অনুসরণ করে ঘরোয়াভাবে মাছের পুষ্টি উপাদান তৈরি করা যেতে পারে:

১. ফারমেন্টেড ফিশ অয়েল

মাছের তেল ভিটামিন A, D, E এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের উত্তম উৎস। এটি তৈরির জন্য:

  • ছোট মাছ (যেমন – পুটি, মলা, খলিশা ইত্যাদি) পরিষ্কার করে কুচি কুচি করে কাটুন।
  • একটি পাত্রে মাছ, লবণ (মাছের ওজনের ১০-১৫%) এবং গুঁড়ো হলুদ (মাছের ওজনের ০.৫-১%) মিশিয়ে রাখুন।
  • পাত্রটি বায়ুরোধী করে ১৫-২০ দিন রেখে দিন।
  • ১৫-২০ দিন পর পাত্র থেকে তেল সংগ্রহ করুন।
  • এই তেল প্রতি কেজি খাবারে ২০-৩০ মিলি হারে মিশিয়ে ব্যবহার করুন।

২. গাঁজানো সয়াবিন

সয়াবিন উচ্চমানের প্রোটিন ও অপরিহার্য এমাইনো অ্যাসিডের উৎস। এটি তৈরির জন্য:

  • সয়াবিন পরিষ্কার করে ১২-২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন।
  • পানি ঝরিয়ে একটি পাত্রে নিয়ে ঢেকে রাখুন যাতে অঙ্কুরোদগম হয়।
  • অঙ্কুরোদগম হলে রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করুন।
  • এই গুঁড়ো প্রতি কেজি খাবারে ১০০-২০০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ব্যবহার করুন।

৩. পাঁচন প্রক্রিয়ায় তৈরি জীবাণু সার

এটি প্রোবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা মাছের হজম ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি তৈরির জন্য:

  • ১০ কেজি গোবর, ২ লিটার গোমূত্র, ১ কেজি গুড় এবং ১০ লিটার পানি একটি প্লাস্টিকের ড্রামে নিন।
  • মিশ্রণটি ভালোভাবে নেড়ে দিন।
  • ড্রামটি ঢেকে ২১ দিন রেখে দিন, প্রতিদিন একবার নেড়ে দিন।
  • ২১ দিন পর এই পাঁচন তরল সংগ্রহ করুন।
  • এই তরল প্রতি শতাংশ পুকুরে ২০০-৩০০ মিলি হারে প্রয়োগ করুন, বা প্রতি কেজি খাবারে ২০-৩০ মিলি হারে মিশিয়ে দিন।

মাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার অন্যান্য উপায়

শুধু ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করেই মাছের বৃদ্ধি সর্বোচ্চ করা সম্ভব নয়। এর সাথে আরও কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে:

১. উন্নত জাতের পোনা ব্যবহার

ভাল মানের পোনা ছাড়া ভাল ফলন পাওয়া যাবে না। তাই সরকারি বা বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে উন্নত জাতের পোনা সংগ্রহ করুন। বিশেষ করে দ্রুত বৃদ্ধিশীল জাত যেমন – গিফট তিলাপিয়া, থাই পাঙ্গাস, রাজপুঁটি ইত্যাদি বেছে নিতে পারেন।

২. সঠিক ঘনত্বে মাছ মজুদ

অতিরিক্ত ঘনত্বে মাছ মজুদ করলে খাবার ও অক্সিজেনের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়ে, ফলে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সাধারণত প্রতি শতাংশে রুই জাতীয় মাছ ৫-৬টি, পাঙ্গাস ৮-১০টি, তিলাপিয়া ১৫-২০টি মজুদ করা উচিত।

৩. নিয়মিত পানির গুণাগুণ পরিবীক্ষণ

মাছের বৃদ্ধির জন্য পানির উপযুক্ত গুণাগুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত pH (৭.৫-৮.৫), অ্যামোনিয়া (<০.১ ppm), নাইট্রাইট (<০.১ ppm), অক্সিজেন (>৫ ppm) পরিমাপ করুন এবং প্রয়োজনে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিন।

৪. নিয়মিত পুকুর প্রস্তুতি ও রক্ষণাবেক্ষণ

মাছ ছাড়ার আগে পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করুন। প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন, ৩-৫ কেজি গোবর ও ১০০-২০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করুন। এছাড়া মাঝে মাঝে প্রবায়োটিক ও জৈব সার প্রয়োগ করে পানির গুণাগুণ উন্নত রাখুন।

৫. রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

রোগাক্রান্ত মাছ সঠিকভাবে বৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। তাই নিয়মিত মাছ পর্যবেক্ষণ করুন এবং যেকোনো রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিয়মিত চুন, লবণ ও প্রবায়োটিক ব্যবহার করুন।

প্রশ্নোত্তর (FAQ)

প্রশ্ন ১: মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন কোনটি?

উত্তর: মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট ভিটামিন বলা যাবে না, কারণ সব ভিটামিনই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। তবে ভিটামিন C, E, এবং B-কমপ্লেক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন C কোলাজেন গঠন, ভিটামিন E অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে এবং B-কমপ্লেক্স বিপাক ক্রিয়ায় সাহায্য করে।

প্রশ্ন ২: ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান কতদিন পর পর ব্যবহার করতে হবে?

উত্তর: ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান প্রতিদিন খাবারের সাথে মিশিয়ে দেওয়া উত্তম। তবে যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন ব্যবহার করুন। তরল ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান যেগুলো সরাসরি পুকুরে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলো সপ্তাহে ১-২ বার ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রশ্ন ৩: ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদানের অতিরিক্ত ব্যবহার কি ক্ষতিকর?

উত্তর: হ্যাঁ, অতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন (A, D, E, K) অতিরিক্ত ব্যবহারে মাছের লিভারে জমা হয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই সবসময় প্যাকেটে উল্লেখিত মাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার করুন।

প্রশ্ন ৪: প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছের জন্য ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান কিভাবে পাওয়া যেতে পারে?

উত্তর: বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছের জন্য ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া যেতে পারে। যেমন – ছোট মাছ (ভিটামিন A, D, প্রোটিন), সয়াবিন (প্রোটিন, ভিটামিন E), গম/ভুট্টা (কার্বোহাইড্রেট, B ভিটামিন), শিম/মটরশুটি (প্রোটিন, ভিটামিন), গাজর (ভিটামিন A), সবুজ শাক-সবজি (ভিটামিন C, ফোলেট), ইস্ট (B-কমপ্লেক্স), সমুদ্র শৈবাল (আয়োডিন, সেলেনিয়াম) ইত্যাদি।

প্রশ্ন ৫: মাছের খাবারে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান মিশানোর সঠিক পদ্ধতি কি?

উত্তর: মাছের খাবারে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান মিশানোর সঠিক পদ্ধতি হল – প্রথমে খাবারের একটি ছোট অংশে (যেমন – ১০০ গ্রাম) ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ভালভাবে মিশিয়ে নিন। এরপর এই মিশ্রণকে বাকি খাবারের সাথে ধীরে ধীরে মিশিয়ে নিন। যদি দানাদার খাবার হয়, তাহলে প্রথমে খাবার কিছুটা নরম করতে অল্প পানি ছিটিয়ে, তারপর ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান মিশিয়ে দিন। মিশ্রণটি ঘন্টাখানেক রেখে তারপর মাছকে খাওয়ান।

প্রশ্ন ৬: নার্সারি পুকুরে কি ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করা উচিত?

উত্তর: হ্যাঁ, নার্সারি পুকুরে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাছের পোনার বয়স যখন কম থাকে, তখন তাদের বৃদ্ধির হার বেশি থাকে এবং তারা প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান না পেলে সহজেই মৃত্যুবরণ করতে পারে। নার্সারি পুকুরে বিশেষ করে ভিটামিন C, E, A এবং B-কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া প্রতি শতাংশে ৫০-১০০ গ্রাম ইস্ট পাউডার সপ্তাহে একবার প্রয়োগ করলে পানিতে প্লাংকটন বৃদ্ধি পায়, যা পোনার প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে কাজ করে।

প্রশ্ন ৭: মাছের ডিম উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কোন ভিটামিন বেশি কার্যকরী?

উত্তর: মাছের ডিম উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ভিটামিন E, C, A এবং B-কমপ্লেক্স বেশি কার্যকরী। বিশেষ করে ভিটামিন E (টোকোফেরল) প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ডিমের গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (যেমন – ফিশ অয়েল, সয়াবিন অয়েল) ডিম উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। ব্রুড মাছকে প্রজনন মৌসুমের ২-৩ মাস আগে থেকে এই ধরনের পুষ্টি উপাদান খাওয়ানো উচিত।

প্রশ্ন ৮: বাজারে পাওয়া ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান কতদিন সংরক্ষণ করা যায়?

উত্তর: বাজারে পাওয়া ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান সাধারণত প্যাকেটে উল্লেখিত মেয়াদ (সাধারণত উৎপাদন তারিখ থেকে ১-২ বছর) পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে প্যাকেট খোলার পর এগুলো ৩-৬ মাসের বেশি সংরক্ষণ করা উচিত নয়। সংরক্ষণের জন্য ঠান্ডা, শুষ্ক ও আলোকবিহীন স্থান নির্বাচন করুন এবং বায়ুরোধী পাত্রে রাখুন। তরল ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান প্যাকেট খোলার পর ২-৩ মাসের মধ্যে ব্যবহার করা উচিত।

প্রশ্ন ৯: ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহারের সময় কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?

উত্তর: ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহারের সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে:

  • সবসময় প্যাকেটে উল্লেখিত মাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার করুন।
  • একাধিক ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান একসাথে ব্যবহার করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
  • ব্যবহারের সময় দস্তানা পরুন এবং ত্বকে লাগলে দ্রুত ধুয়ে ফেলুন।
  • মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ব্যবহার করবেন না।
  • অতিরিক্ত ব্যবহার করবেন না, এতে পুকুরের পানির গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে।
  • শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।

প্রশ্ন ১০: কোন সময় মাছকে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান খাওয়ানো উচিত?

উত্তর: মাছকে সকালে (৮-১০টা) ও বিকালে (৪-৬টা) ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। এই সময়গুলোতে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বেশি থাকে এবং মাছ সক্রিয় থাকে। মধ্যাহ্নে সূর্যের তীব্র তাপে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ফলে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায় এবং মাছ কম সক্রিয় থাকে। দুপুরের সময় খাবার দেওয়া উচিত নয়, কারণ এই সময় মাছের হজম ক্রিয়া ধীর হয়ে যায়।

উপসংহার

মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন A, D, E, C, B-কমপ্লেক্স, প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, এমাইনো অ্যাসিড ইত্যাদি মাছের সুস্থ বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাছ দ্রুত বৃদ্ধির ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, যেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করে মাছের উৎপাদন ৪০-৫০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।

তবে শুধু ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করেই সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে না। এর সাথে উন্নত জাতের পোনা ব্যবহার, সঠিক ঘনত্বে মাছ মজুদ, নিয়মিত পানির গুণাগুণ পরিবীক্ষণ, পুকুর প্রস্তুতি ও রক্ষণাবেক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মৎস্য চাষীদের মাঝে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী খামারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে স্বল্প মূল্যে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা যেতে পারে।

উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করে আমাদের দেশের মৎস্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে। প্রতিটি মৎস্য চাষী যদি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের আয় বাড়বে এবং দেশের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।

তথ্যসূত্র

১. বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI), (২০২৪), “মাছের পুষ্টি চাহিদা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা”, ময়মনসিংহ।

২. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (BAU), (২০২৩), “মৎস্যপালনে পুষ্টি উপাদানের ভূমিকা”, ময়মনসিংহ।

৩. মৎস্য অধিদপ্তর, (২০২৩), “বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩”, ঢাকা।

৪. বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, (২০২৩), “কৃষি ও মৎস্য খাত”, অর্থ মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

৫. দেবনাথ, এস. কে., (২০২২), “আধুনিক মৎস্য চাষ পদ্ধতি”, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৬. খান, এম. এস., (২০২৩), “মাছের পুষ্টি ও ভিটামিন চাহিদা”, কৃষি প্রকাশনী, ঢাকা।

৭. FAO, (2023), “The State of World Fisheries and Aquaculture”, Rome.

৮. National Research Council, (2022), “Nutrient Requirements of Fish and Shrimp”, National Academies Press, Washington, D.C.

৯. Rahman, M. M., (2023), “Effect of Vitamin Premix on Growth Performance of Carp”, Journal of Fisheries, 12(1): 45-52.

১০. Ahmed, G. U., (2023), “Importance of Vitamins and Minerals in Fish Nutrition”, Bangladesh Journal of Aquaculture, 8(2): 78-86.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button