রুই মাছ কোন স্তরে থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে

রুই মাছ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মিঠা পানির মাছ। এই মাছটি শুধুমাত্র খাদ্য হিসেবেই নয়, বরং আমাদের দেশের মৎস্য চাষ শিল্পে একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিচিত। রুই মাছের জীবনযাত্রা, বিশেষ করে এটি পানির কোন স্তরে বাস করে এবং কীভাবে খাদ্য গ্রহণ করে – এই বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য চাষিদের জন্য এই তথ্যগুলো জানা প্রয়োজনীয়, কারণ এর উপর নির্ভর করে সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি এবং খাদ্য প্রয়োগের কৌশল।

রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Labeo rohita। এটি কার্প পরিবারের অন্তর্গত একটি মাছ যা প্রাকৃতিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের নদী-নালা, বিল-ঝিলে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মাছটি কৃত্রিম পুকুরে ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে এবং এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রুই মাছের পানির স্তর পরিচিতি

পানির বিভিন্ন স্তর

পানির গভীরতা অনুযায়ী সাধারণত তিনটি প্রধান স্তর রয়েছে:

১. উপরিভাগ (Surface Layer): পানির উপরের অংশ যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে এবং অক্সিজেনের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে।

২. মধ্যস্তর (Middle Layer): পানির মাঝামাঝি অংশ যেখানে তাপমাত্রা এবং অক্সিজেনের মাত্রা মধ্যম থাকে।

৩. তলদেশ (Bottom Layer): পানির সবচেয়ে নিচের অংশ যেখানে তাপমাত্রা কম এবং জৈব পদার্থ জমা হয়।

রুই মাছের প্রাথমিক স্তর নির্ধারণ

রুই মাছ প্রাথমিকভাবে পানির উপরিভাগ এবং মধ্যস্তরে বাস করে। তবে এটি একটি নির্দিষ্ট স্তরে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বিভিন্ন কারণে এর অবস্থান পরিবর্তিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রুই মাছ সাধারণত পানির উপরিভাগ থেকে মধ্যস্তর পর্যন্ত বিচরণ করে।

স্তর রুই মাছের উপস্থিতি শতকরা হার
উপরিভাগ অধিক ৬০%
মধ্যস্তর মধ্যম ৩৫%
তলদেশ কম ৫%

রুই মাছের খাদ্যাভ্যাস বিশ্লেষণ

প্রাকৃতিক খাদ্য

রুই মাছ একটি সর্বভুক মাছ হলেও এর খাদ্যাভ্যাস বিশেষ ধরনের। এটি প্রধানত নিম্নোক্ত খাবারগুলো গ্রহণ করে:

১. উদ্ভিদজাত খাদ্য (৭০%):

  • ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন
  • জলজ উদ্ভিদের কোমল অংশ
  • শৈবাল
  • পাতা ও ডালের ক্ষুদ্র অংশ

২. প্রাণিজ খাদ্য (৩০%):

  • জুপ্ল্যাঙ্কটন
  • কীটপতঙ্গের লার্ভা
  • ছোট কৃমি
  • পানির ক্ষুদ্র প্রাণী

খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতি

রুই মাছের খাদ্য গ্রহণের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। এই মাছের মুখে বিশেষ ধরনের ফিল্টার রয়েছে যা দিয়ে এটি পানি থেকে খাদ্য কণা আলাদা করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “ফিল্টার ফিডিং”।

খাদ্য গ্রহণের ধাপ:

  1. পানি মুখে নেওয়া
  2. গিল র‍্যাকার দিয়ে ছাঁকা
  3. খাদ্য কণা আলাদা করা
  4. পানি বের করে দেওয়া
  5. খাদ্য গিলে ফেলা

বয়স অনুযায়ী স্তর পরিবর্তন

পোনা অবস্থা (০-৩ মাস)

পোনা অবস্থায় রুই মাছ প্রধানত পানির উপরিভাগে থাকে। এই সময় এদের খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন:

  • অবস্থান: পানির উপরিভাগে (৯০%)
  • খাদ্য: মূলত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এবং জুপ্ল্যাঙ্কটন
  • খাদ্য গ্রহণ: দিনে ৮-১০ বার
  • বৃদ্ধির হার: দৈনিক ৫-৮%

কিশোর অবস্থা (৩-১২ মাস)

এই পর্যায়ে রুই মাছ উপরিভাগ এবং মধ্যস্তরে বিচরণ করে:

  • অবস্থান: উপরিভাগ ৭০%, মধ্যস্তর ৩০%
  • খাদ্য: মিশ্র খাদ্য (উদ্ভিদ ও প্রাণিজ)
  • খাদ্য গ্রহণ: দিনে ৬-৮ বার
  • বৃদ্ধির হার: দৈনিক ৩-৫%

পূর্ণবয়স্ক অবস্থা (১ বছরের বেশি)

পূর্ণবয়স্ক রুই মাছ সব স্তরেই বিচরণ করে তবে প্রধানত উপরিভাগে থাকে:

  • অবস্থান: উপরিভাগ ৬০%, মধ্যস্তর ৩৫%, তলদেশ ৫%
  • খাদ্য: প্রাপ্ত সব ধরনের খাদ্য
  • খাদ্য গ্রহণ: দিনে ৪-৬ বার
  • বৃদ্ধির হার: দৈনিক ১-৩%

পরিবেশগত ফ্যাক্টরের প্রভাব

তাপমাত্রার প্রভাব

তাপমাত্রা রুই মাছের স্তর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

তাপমাত্রা মাছের অবস্থান খাদ্য গ্রহণের হার
২৫-৩০°C উপরিভাগে বেশি সর্বোচ্চ
২০-২৫°C মধ্যস্তরে বেশি মধ্যম
১৫-২০°C গভীরে বেশি কম
১৫°C এর নিচে তলদেশে খুব কম

অক্সিজেনের মাত্রা

অক্সিজেনের মাত্রা রুই মাছের জীবনযাত্রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

উচ্চ অক্সিজেন (৬-৮ ppm):

  • উপরিভাগে বেশি থাকে
  • খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি পায়
  • সক্রিয়তা বেশি থাকে

মধ্যম অক্সিজেন (৪-৬ ppm):

  • মধ্যস্তরে বিচরণ করে
  • স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ
  • মধ্যম সক্রিয়তা

কম অক্সিজেন (২-৪ ppm):

  • পানির উপরে আসে
  • খাদ্য গ্রহণ কমে যায়
  • চাপ অনুভব করে

pH এর প্রভাব

পানির pH রুই মাছের খাদ্য গ্রহণ এবং স্তর নির্বাচনে প্রভাব ফেলে:

  • আদর্শ pH (৭.০-৮.৫): সর্বোত্তম অবস্থা
  • অম্লীয় pH (৬.০-৭.০): মধ্যম প্রভাব
  • ক্ষারীয় pH (৮.৫-৯.০): সামান্য প্রভাব

ঋতু অনুযায়ী আচরণ

গ্রীষ্মকাল

গ্রীষ্মকালে রুই মাছের আচরণ:

  • সকাল ও সন্ধ্যায় উপরিভাগে
  • দুপুরে গভীরে চলে যায়
  • খাদ্য গ্রহণ বেশি হয়
  • প্রজনন মৌসুম

বর্ষাকাল

বর্ষাকালে বিশেষ পরিবর্তন:

  • পানির উপরিভাগে বেশি সময়
  • নতুন খাদ্যের সন্ধান
  • সক্রিয়তা বৃদ্ধি
  • বৃদ্ধির হার বেশি

শীতকাল

শীতকালে আচরণগত পরিবর্তন:

  • তলদেশে বেশি সময়
  • খাদ্য গ্রহণ কমে যায়
  • সক্রিয়তা হ্রাস
  • বৃদ্ধি ধীর হয়

চাষাবাদে গুরুত্ব

পুকুর ব্যবস্থাপনা

রুই মাছের স্তর জ্ঞান পুকুর ব্যবস্থাপনায় সহায়ক:

১. গভীরতা নির্ধারণ:

  • ন্যূনতম ৩-৪ ফুট গভীরতা প্রয়োজন
  • সর্বোচ্চ ৮-১০ ফুট গভীরতা উপযুক্ত

২. খাদ্য প্রয়োগ:

  • পানির উপরিভাগে খাদ্য দিতে হবে
  • মধ্যস্তরে খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে

৩. অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা:

  • উপরিভাগে অক্সিজেনের মাত্রা বজায় রাখা
  • প্রয়োজনে এয়ারেশন ব্যবহার

মিশ্র চাষে ভূমিকা

রুই মাছ মিশ্র চাষে গুরুত্বপূর্ণ:

মাছের ধরন পানির স্তর খাদ্যের ধরন
রুই উপরিভাগ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন
কাতলা উপরিভাগ জুপ্ল্যাঙ্কটন
মৃগেল তলদেশ জৈব পদার্থ
কালবাউস মধ্যস্তর মিশ্র খাদ্য

খাদ্য প্রয়োগের কৌশল

প্রাকৃতিক খাদ্য বৃদ্ধি

সার প্রয়োগ:

  • গোবর সার: ৫০০-৭০০ কেজি/একর/বছর
  • ইউরিয়া: ১০-১৫ কেজি/একর/বছর
  • টিএসপি: ৮-১২ কেজি/একর/বছর

চুন প্রয়োগ:

  • প্রতি বছর ২৫০-৩০০ কেজি/একর
  • pH নিয়ন্ত্রণের জন্য

কৃত্রিম খাদ্য

পুষ্টিগুণ:

  • আমিষ: ২৫-৩০%
  • শর্করা: ৩৫-৪০%
  • চর্বি: ৫-৮%
  • আঁশ: ৮-১০%

খাদ্য প্রয়োগের সময়:

  • সকাল ৮-৯টা
  • বিকাল ৪-৫টা
  • সন্ধ্যা ৬-৭টা

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা

রোগ প্রতিরোধ

রুই মাছের স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয়:

১. পানির গুণগত মান বজায় রাখা:

  • অক্সিজেনের মাত্রা ৫ ppm এর বেশি
  • pH ৭.০-৮.৫ এর মধ্যে
  • তাপমাত্রা ২৫-৩০°C

২. নিয়মিত পরিচর্যা:

  • মাসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা
  • প্রয়োজনে ওষুধ প্রয়োগ
  • পানি পরিবর্তন

সাধারণ রোগবালাই

১. ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ:

  • লক্ষণ: ঘা, পচন
  • চিকিৎসা: অ্যান্টিবায়োটিক

২. ছত্রাকজনিত রোগ:

  • লক্ষণ: সাদা আবরণ
  • চিকিৎসা: ছত্রাকনাশক

৩. পরজীবীজনিত রোগ:

  • লক্ষণ: চুলকানি, ক্ষত
  • চিকিৎসা: পরজীবীনাশক

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বাজার মূল্য

রুই মাছের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি:

আকার ওজন বাজার মূল্য (টাকা/কেজি)
ছোট ৫০০গ্রাম-১কেজি ১৮০-২২০
মাঝারি ১-২কেজি ২২০-২৮০
বড় ২কেজির বেশি ২৮০-৩৫০

লাভজনকতা

রুই মাছ চাষের লাভজনকতা:

বিনিয়োগ (প্রতি একরে):

  • পোনা ক্রয়: ১৫,০০০ টাকা
  • খাদ্য: ২৫,০০০ টাকা
  • সার ও ওষুধ: ৮,০০০ টাকা
  • শ্রমিক খরচ: ১২,০০০ টাকা
  • মোট: ৬০,০০০ টাকা

আয় (প্রতি একরে):

  • মাছ বিক্রয়: ৯৫,০০০ টাকা
  • নীট লাভ: ৩৫,০০০ টাকা

FAQ (প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন)

১. রুই মাছ কোন স্তরে বেশি সময় কাটায়? রুই মাছ প্রধানত পানির উপরিভাগে বেশি সময় কাটায়। প্রায় ৬০% সময় এরা পানির উপরিভাগে থাকে।

২. রুই মাছের প্রধান খাদ্য কী? রুই মাছের প্রধান খাদ্য ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। এছাড়াও এরা জলজ উদ্ভিদ, শৈবাল এবং জুপ্ল্যাঙ্কটন খায়।

৩. দিনে কতবার রুই মাছ খাদ্য গ্রহণ করে? বয়স অনুযায়ী ভিন্ন হয়। পোনা অবস্থায় ৮-১০ বার, কিশোর অবস্থায় ৬-৮ বার এবং পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ৪-৬ বার।

৪. শীতকালে রুই মাছের আচরণ কেমন হয়? শীতকালে রুই মাছ তলদেশে বেশি সময় কাটায় এবং খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়।

৫. রুই মাছ চাষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী? পানির গুণগত মান বজায় রাখা, বিশেষ করে অক্সিজেনের মাত্রা এবং উপযুক্ত খাদ্য প্রয়োগ।

৬. কোন পানির তাপমাত্রায় রুই মাছ ভালো বৃদ্ধি পায়? ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রুই মাছ সবচেয়ে ভালো বৃদ্ধি পায়।

৭. রুই মাছের পানির আদর্শ pH কত? রুই মাছের জন্য আদর্শ pH হলো ৭.০-৮.৫।

৮. মিশ্র চাষে রুই মাছের সাথে কোন মাছ ভালো? কাতলা, মৃগেল, কালবাউস এবং সিলভার কার্প মাছের সাথে রুই মাছের মিশ্র চাষ ভালো হয়।

উপসংহার

রুই মাছের পানির স্তর এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জ্ঞান মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাছটি প্রধানত পানির উপরিভাগ এবং মধ্যস্তরে বাস করে এবং ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও অন্যান্য জলজ খাদ্য গ্রহণ করে। বিভিন্ন পরিবেশগত ফ্যাক্টর যেমন তাপমাত্রা, অক্সিজেনের মাত্রা এবং ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এর আচরণও পরিবর্তিত হয়।

সঠিক জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে রুই মাছ চাষ করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়া সম্ভব। আমাদের দেশের মৎস্য চাষিরা যদি রুই মাছের এই প্রাকৃতিক আচরণ সম্পর্কে সচেতন হন এবং সেই অনুযায়ী চাষাবাদ করেন, তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের স্বাস্থ্য ও গুণগত মানও উন্নত হবে।

ভবিষ্যতে রুই মাছ চাষে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন ক্রমাগত গবেষণা এবং চাষিদের যথাযথ প্রশিক্ষণ। রুই মাছ আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে যদি আমরা এর সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করি।

Leave a Comment