সাকার মাছ কি হালাল

সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে বিচরণকারী প্রাণীদের মধ্যে হাঙর বা সাকার (Shark) একটি উল্লেখযোগ্য প্রজাতি। বিশ্বব্যাপী এর প্রায় ৫০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে, যেগুলো আকার, আচরণ এবং বাসস্থান হিসেবে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে। মুসলিম বিশ্বে খাদ্য সম্পর্কিত আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কোনটি হালাল (অনুমোদিত) এবং কোনটি হারাম (নিষিদ্ধ)। সাকার মাছ বা হাঙর ক্রমশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, ইসলামিক দৃষ্টিকোণে সাকার মাছ খাওয়া হালাল কি না?
এই আর্টিকেলে আমরা সাকার মাছের হালাল-হারাম বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারদের মতামত, বিভিন্ন মাজহাবের (ইসলামিক আইনি স্কুল) দৃষ্টিকোণ এবং কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। সাথে সাকার মাছের পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিও তুলে ধরা হবে।
সাকার মাছ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা
সাকার মাছ বা হাঙর হল একধরনের কার্টিলেজিনাস মাছ যা ক্লাস কন্ড্রিকথিস (Chondrichthyes) এর অন্তর্গত। এদের কঙ্কাল হাড় দিয়ে নয়, বরং কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি দিয়ে গঠিত, যা এদের শরীরকে অধিক নমনীয় করে তোলে। হাঙরের দেহে বিশেষ স্কেল থাকে যাকে ডার্মাল ডেন্টিকলস (dermal denticles) বলা হয়, যা দেখতে অনেকটা ছোট দাঁতের মতো।
সাকার মাছের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো:
- এরা সাধারণত মাংসাশী এবং প্রধানত অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে।
- বেশিরভাগ হাঙরের দেহে ৫-৭টি গিল স্লিট থাকে।
- এদের চোয়ালে শক্তিশালী দাঁত থাকে যা নিয়মিত নতুন দাঁত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
- এদের চামড়া খসখসে এবং কঠিন হয়।
বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত কিছু হাঙর প্রজাতি হল: গ্রেট হোয়াইট শার্ক, টাইগার শার্ক, হ্যামারহেড শার্ক, ব্লু শার্ক, বুল শার্ক ইত্যাদি।
ইসলামে খাদ্য নির্ধারণের মূলনীতি
ইসলামে খাদ্য সম্পর্কিত বিধিবিধান কোরআন এবং হাদিস থেকে নেওয়া হয়। কোরআনের সূরা আল-বাকারা (২:১৭২-১৭৩), সূরা আল-মায়িদাহ (৫:৪-৫), এবং সূরা আল-আনআম (৬:১৪৫) সহ বিভিন্ন স্থানে খাদ্যের হালাল-হারাম সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইসলামিক ফিকহে (আইনশাস্ত্র) খাদ্য সম্পর্কিত মূলনীতিগুলো:
১. আসল নিয়ম হল অনুমতি: ইসলামে মূলনীতি হল, যেকোনো খাদ্য মূলত হালাল, যদি না সেটি সুনির্দিষ্টভাবে হারাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২. সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা: কিছু খাদ্য স্পষ্টভাবে হারাম হিসেবে ঘোষিত, যেমন: শূকরের মাংস, রক্ত, মৃত প্রাণীর মাংস (যাকে জবাই করা হয়নি), এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে জবাই করা প্রাণী।
৩. স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা: খাদ্য অবশ্যই পরিষ্কার, স্বাস্থ্যকর এবং মানুষের জন্য উপকারী হতে হবে।
৪. সমুদ্রের খাবার: সাগর-মহাসাগরের খাবার সম্পর্কে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে।
বিভিন্ন মাজহাবের দৃষ্টিকোণে সাকার মাছ
ইসলামে চারটি প্রধান সুন্নি মাজহাব (আইনি স্কুল) রয়েছে: হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি। এছাড়াও শিয়া মাজহাবও রয়েছে। এই বিভিন্ন মাজহাবের সাকার মাছ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপ:
হানাফি মাজহাব:
হানাফি মাজহাব অনুসারে, শুধুমাত্র স্কেল-যুক্ত মাছই হালাল। যেহেতু সাকার মাছের শরীরে আমরা যে ধরনের স্কেল আশা করি তা নেই (এদের শরীরে ডার্মাল ডেন্টিকল নামক বিশেষ স্কেল আছে), তাই হানাফি মাজহাবের অনেক স্কলার সাকার মাছকে হালাল হিসেবে বিবেচনা করেন না। তবে এই বিষয়ে হানাফি মাজহাবের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে।
বিখ্যাত হানাফি আলেম ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন: “সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে শুধুমাত্র মাছই হালাল, এবং সেগুলো অবশ্যই স্বাভাবিক আকারের মাছ হতে হবে।”
হানাফি মাজহাবের অন্যান্য স্কলারদের মতে, সমুদ্রের যেসব প্রাণী আকৃতিগতভাবে মাছের মতো এবং শুধুমাত্র পানিতেই বাস করে, সেগুলোই হালাল।
মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি মাজহাব:
এই তিনটি মাজহাব অনুযায়ী, সমুদ্রের সকল জীবিত প্রাণী হালাল। এদের মতে, সাকার মাছ খাওয়া সম্পূর্ণ হালাল। এরা নিম্নোক্ত কোরআনের আয়াত ও হাদিসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন:
কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও খাদ্য হালাল করা হয়েছে, তোমাদের ও মুসাফিরদের উপকারার্থে।” (সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৯৬)
একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “সমুদ্রের পানি পবিত্র এবং তার মৃত প্রাণীও হালাল।” (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
শিয়া মাজহাব:
শিয়া মাজহাবের অনুসারীদের মতে, শুধুমাত্র স্কেল-যুক্ত মাছই হালাল। এদের দৃষ্টিতে, যেহেতু সাকার মাছের প্রচলিত অর্থে স্কেল নেই, তাই এটি হারাম বলে বিবেচিত হয়।
জাফরি ফিকহ অনুসারে, একটি মাছ হালাল হওয়ার জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:
- মাছের শরীরে স্কেল থাকতে হবে।
- মাছটি পানিতে জীবিত থাকতে ধরা হতে হবে।
- মাছটি পানির বাইরে মারা যেতে হবে।
সাকার মাছের স্কেল এবং বিতর্ক
সাকার মাছের শরীরে ডার্মাল ডেন্টিকল (dermal denticles) নামে একধরনের বিশেষ স্কেল থাকে, যা দেখতে অনেকটা ছোট দাঁতের মতো। এগুলো প্রকৃতপক্ষে দাঁতের অনুরূপ গঠন বিশিষ্ট এবং একই উপাদান (ডেন্টিন) দিয়ে তৈরি। এই ডার্মাল ডেন্টিকলগুলো সাকার মাছের ত্বককে খসখসে বানায় এবং সাঁতার কাটার সময় জলের বাধা কমিয়ে দেয়।
বিতর্কের মূল বিষয় হল, এই ডার্মাল ডেন্টিকলগুলোকে প্রকৃত স্কেল হিসেবে গণ্য করা যাবে কিনা। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, এগুলো প্লাকয়েড স্কেল (placoid scales) নামে পরিচিত, যা অন্যান্য মাছের সাইক্লয়েড বা টেনয়েড স্কেল থেকে ভিন্ন।
ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে এই বিষয়ে দুটি প্রধান মতামত রয়েছে:
১. প্রথম মত: কিছু স্কলার মনে করেন, ডার্মাল ডেন্টিকল প্রকৃত স্কেল নয়, তাই সাকার মাছ হালাল নয়।
২. দ্বিতীয় মত: অন্যান্য স্কলারদের মতে, ডার্মাল ডেন্টিকল একধরনের স্কেলই, যদিও এগুলো অন্যান্য মাছের স্কেল থেকে ভিন্ন। তাই সাকার মাছ হালাল।
আধুনিক গবেষণার আলোকে সাকার মাছ
আধুনিক বিজ্ঞানে সাকার মাছের শরীরবিদ্যা ও জীববিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক গবেষণা হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো থেকে নিম্নলিখিত তথ্যগুলো পাওয়া যায়:
- সাকার মাছের ডার্মাল ডেন্টিকল আসলে তাদের চামড়ার উপরে থাকা দাঁতের মতো গঠন, যা বিজ্ঞানীরা প্লাকয়েড স্কেল হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেন।
- এই স্কেলগুলো সাকার মাছকে পানিতে দ্রুত সাঁতার কাটতে সাহায্য করে এবং প্রতিরক্ষা প্রদান করে।
- জীববিজ্ঞানীরা সাকার মাছকে ইলাসমোব্রাঙ্কি (Elasmobranchii) উপশ্রেণীর অন্তর্গত বলে শ্রেণীবদ্ধ করেন, যা হাড়বিহীন মেরুদণ্ডী প্রাণী।
স্কেলের উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, সাকার মাছের শরীরে প্লাকয়েড স্কেল আছে, যা তাদের অন্যান্য মাছ থেকে আলাদা করে। তবে এই স্কেল সাধারণ মাছের স্কেল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।
সাকার মাছের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
সাকার মাছ পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি খাদ্য। এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা নিম্নরূপ:
পুষ্টি উপাদান:
পুষ্টি উপাদান | পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম) |
---|---|
ক্যালোরি | ১৩০-১৮০ |
প্রোটিন | ২০-২৫ গ্রাম |
চর্বি | ৪-৮ গ্রাম |
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড | উচ্চ মাত্রায় |
ভিটামিন বি১২ | উল্লেখযোগ্য পরিমাণে |
ভিটামিন ডি | উল্লেখযোগ্য পরিমাণে |
আয়রন | মধ্যম থেকে উচ্চ পরিমাণে |
সেলেনিয়াম | উচ্চ মাত্রায় |
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
১. হৃদরোগ প্রতিরোধ: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত সাকার মাছ খেলে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড কমে এবং HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়ে।
২. মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং বয়স সম্পর্কিত জ্ঞানীয় অবনতি রোধে সাহায্য করে।
৩. দৃষ্টিশক্তি উন্নয়ন: DHA নামক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রেটিনার স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪. শক্তিশালী হাড়: সাকার মাছে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. প্রদাহ কমানো: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
সাকার মাছ গ্রহণে সতর্কতা
সাকার মাছের উপকারিতা থাকলেও, এটি খাওয়ার সময় কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
১. মার্কারি দূষণ: বড় আকারের হাঙর মাছে মার্কারির মাত্রা বেশি থাকতে পারে। মার্কারি স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
২. জৈব দূষক: সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দূষণের কারণে, সাকার মাছে PCBs, ডায়ক্সিন এবং অন্যান্য দূষক থাকতে পারে।
৩. অ্যালার্জি: কিছু ব্যক্তির সামুদ্রিক খাবারে অ্যালার্জি থাকতে পারে।
৪. জীবাণু সংক্রমণ: অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ বা অসম্পূর্ণ রান্নার কারণে সাকার মাছে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও বিভিন্ন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলো হাঙর মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে সীমিত পরিমাণে গ্রহণের পরামর্শ দেয়, বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মায়েরা এবং ছোট বাচ্চাদের জন্য।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাকার মাছের ব্যবহার
সাকার মাছ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে প্রস্তুত ও সেবন করা হয়:
১. আইসল্যান্ড: হাঙরের মাংস ফার্মেন্টেশন করে “হাকার্ল” (Hákarl) নামক একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করা হয়।
২. জাপান: “ফুকা” (Fuka) নামে হাঙরের মাংস বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালীতে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে সুশিতে।
৩. চীন: হাঙরের পাখনা দিয়ে বিখ্যাত “শার্ক ফিন সুপ” তৈরি করা হয়, যদিও পরিবেশগত কারণে এর সমালোচনা রয়েছে।
৪. স্পেন: “কাজন” (Cazón en adobo) নামে একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারে ছোট হাঙর ব্যবহার করা হয়।
৫. মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া: এসব দেশে হাঙরের মাংস বিভিন্ন কারিতে ব্যবহার করা হয়।
৬. ভারত ও বাংলাদেশ: উপকূলীয় অঞ্চলে ছোট আকারের হাঙর মাছ রান্না করে খাওয়া হয়।
সাকার মাছ ও পরিবেশগত চিন্তা
ইসলামে প্রাকৃতিক পরিবেশের সংরক্ষণ ও ভারসাম্য রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল-কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন: “পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, যখন তা সংস্কার করা হয়েছে।” (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬)
সাকার মাছ সম্পর্কিত পরিবেশগত চিন্তাগুলো:
১. বিপন্ন প্রজাতি: বিশ্বব্যাপী অনেক হাঙর প্রজাতি বিপন্ন বা অতিবিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত। IUCN রেড লিস্ট অনুসারে, প্রায় ৩০% হাঙর ও রেই প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
২. অতিরিক্ত শিকার: অতিরিক্ত ও অবৈধ শিকারের কারণে হাঙরের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বার্ষিক প্রায় ১০ কোটি হাঙর শিকার করা হয়।
৩. পরিবেশগত ভারসাম্য: হাঙর সামুদ্রিক ইকোসিস্টেমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা প্রেডেটর হিসেবে সমুদ্রের খাদ্য-শৃঙ্খলে ভারসাম্য রক্ষা করে।
৪. ফিনিং (Finning): শুধুমাত্র পাখনার জন্য হাঙর ধরে, পাখনা কেটে নিয়ে বাকি শরীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার অমানবিক প্রথা রয়েছে।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাণীদের প্রতি দয়া দেখানো মুসলিমদের দায়িত্ব। তাই, হাঙর খাওয়া হালাল হলেও, বিপন্ন প্রজাতির হাঙর শিকার ও ভোজন করা উচিত নয়।
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. সাকার মাছ কি হালাল?
উত্তর: এই বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি মাজহাব অনুসারে সাকার মাছ হালাল, কিন্তু হানাফি ও শিয়া মাজহাবের অধিকাংশ স্কলার এটিকে হারাম বলে মনে করেন, কারণ এতে প্রচলিত অর্থে স্কেল নেই।
২. সাকার মাছে কি স্কেল আছে?
উত্তর: সাকার মাছে সাধারণ স্কেল নেই, কিন্তু ডার্মাল ডেন্টিকল (dermal denticles) নামে বিশেষ ধরনের স্কেল আছে, যা প্লাকয়েড স্কেল হিসেবে পরিচিত।
৩. সাকার মাছ খাওয়ার স্বাস্থ্য ঝুঁকি কি?
উত্তর: সাকার মাছে মার্কারি, PCBs, এবং অন্যান্য ভারী ধাতু থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে বড় আকারের এবং বয়স্ক হাঙরে এসব দূষকের মাত্রা বেশি থাকে।
৪. সাকার মাছের স্বাস্থ্য উপকারিতা কি?
উত্তর: সাকার মাছে উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা হৃদরোগ, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
৫. বাংলাদেশে কি সাকার মাছ পাওয়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট হাঙর পাওয়া যায়, যেগুলো স্থানীয়ভাবে “হাঙর মাছ” বা “কামট মাছ” নামে পরিচিত।
৬. হানাফি মাজহাবের অনুসারীরা কি সাকার মাছ খেতে পারেন?
উত্তর: হানাফি মাজহাবের অধিকাংশ স্কলারের মতে, সাকার মাছ হারাম, কিন্তু এই বিষয়ে মাজহাবের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে। যদি কেউ হানাফি মাজহাব অনুসরণ করেন, তাহলে তার নির্ভরযোগ্য ইসলামিক স্কলারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৭. কোন কোন দেশে সাকার মাছ খাওয়া হয়?
উত্তর: আইসল্যান্ড, জাপান, চীন, কোরিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে সাকার মাছ খাওয়া হয়।
৮. বিপন্ন হাঙর প্রজাতি খাওয়া কি ইসলামিক দৃষ্টিকোণে অনুমোদিত?
উত্তর: ইসলাম পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভারসাম্য রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়। তাই বিপন্ন প্রজাতির হাঙর শিকার ও ভোজন করা উচিত নয়, যদিও তা হালাল হিসেবে বিবেচিত হয়।
৯. শিয়া মুসলিমরা কি সাকার মাছ খেতে পারেন?
উত্তর: শিয়া মাজহাবের অনুসারে, সাকার মাছ হারাম, কারণ এতে প্রচলিত স্কেল নেই।
১০. সাকার মাছের বিকল্প কি?
উত্তর: যারা সাকার মাছ খেতে চান না, তারা স্কেল-যুক্ত সামুদ্রিক মাছ যেমন সালমন, টুনা, ম্যাকেরেল, সার্ডিন ইত্যাদি খেতে পারেন, যেগুলো সকল মাজহাবের মতে হালাল এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
উপসংহার
সাকার মাছ হালাল কিনা সে বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এই মতভেদ মূলত সাকার মাছের শরীরে স্কেলের উপস্থিতি নিয়ে। মালিকি, শাফেয়ি এবং হাম্বলি মাজহাবের মতে, সমুদ্রের সকল জীবিত প্রাণীই হালাল, তাই সাকার মাছও হালাল। অন্যদিকে, হানাফি ও শিয়া মাজহাবের অধিকাংশ স্কলার মনে করেন, স্কেল-বিহীন সামুদ্রিক প্রাণী হালাল নয়, তাই সাকার মাছও হারাম।
আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে, সাকার মাছের শরীরে ডার্মাল ডেন্টিকল নামে বিশেষ ধরনের স্কেল রয়েছে, যা প্লাকয়েড স্কেল হিসেবে পরিচিত। এটি সাধারণ মাছের স্কেল থেকে ভিন্ন, কিন্তু একধরনের স্কেলই।
পুষ্টিগুণের দিক থেকে, সাকার মাছ প্রোটিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে, বড় আকারের হাঙরে মার্কারি এবং অন্যান্য দূষকের মাত্রা বেশি থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
শেষ পর্যন্ত, একজন মুসলিমের জন্য তার অনুসরিত মাজহাবের নীতি মেনে চলাই উত্তম। যদি কেউ হালাল-হারাম বিষয়ে সন্দেহে থাকেন, তবে বিশ্বস্ত ইসলামিক স্কলারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “যদি তোমরা না জান তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর” (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৩)।
পরিশেষে, সাকার মাছ খাওয়া হালাল হলেও, বিপন্ন প্রজাতির হাঙর শিকার ও ভোজন করা উচিত নয়, কারণ ইসলাম পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়। আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবেশের জন্য টেকসই এবং নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।