কোন মাছ খেলে ক্যান্সার হয়
“কোন মাছ খেলে ক্যান্সার হয়” – এই প্রশ্নটি আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন আড্ডাখানায় প্রায়ই শোনা যায়। মাছ বাঙালির প্রিয় খাবার, কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় মাছ এবং ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইন্টারনেটে প্রচুর ভুল তথ্য ছড়িয়ে থাকায় অনেকেই বিভ্রান্তিতে ভুগছেন। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব কোন ধরনের মাছ খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে, কেন বাড়তে পারে, এবং কীভাবে নিরাপদে মাছ খেতে পারেন।
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। মাছ হল আমাদের শরীরের জন্য প্রোটিন, অমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাসিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তবে বিশ্বজুড়ে জলদূষণের কারণে কিছু মাছে ক্ষতিকারক পদার্থের উপস্থিতি বেড়ে গেছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ মিলিয়ন লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৬ মিলিয়ন লোক এতে মারা যায়। পরিবেশগত কারণগুলির মধ্যে খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের খাবার, বিশেষ করে মাছ সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাছ খাওয়া এবং ক্যান্সার: মিথ বনাম বাস্তবতা
মাছ খাওয়া ও ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার: মাছ নিজে কোন ক্যান্সারজনক খাবার নয়। বরং, মাছে থাকা দূষক পদার্থের কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (American Cancer Society) এবং বিশ্ব ক্যান্সার গবেষণা তহবিল (World Cancer Research Fund) এর মতে, মাছ খাওয়া এবং ক্যান্সারের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক নেই। বরং, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত মাছ খাওয়া কিছু ধরনের ক্যান্সার, যেমন কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে, বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের মাছে দূষক পদার্থ থাকতে পারে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এই দূষক পদার্থগুলি সাধারণত পরিবেশগত দূষণের কারণে মাছের শরীরে জমা হয়, যেমন:
- ভারী ধাতু: পারদ (মার্কারি), লেড, আর্সেনিক
- সারফেস ট্রিটমেন্ট কেমিক্যাল: ফর্মালিন, কার্বাইড
- পলিক্লোরিনেটেড বাইফেনাইল (PCBs): শিল্প দূষক
- ডায়োক্সিন: শিল্প ও কৃষি রাসায়নিক
২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, বিশ্বের প্রায় ৪০% সামুদ্রিক জলে দূষণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা সমুদ্রের মাছে দূষক পদার্থের মাত্রা বাড়ায়। ভারতীয় মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের কিছু অংশে ভারী ধাতুর মাত্রা উচ্চ বলে পাওয়া গেছে।
ইউরোপীয় ফুড সেফটি অথরিটি (EFSA) এর ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি সপ্তাহে দুই বারের বেশি উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ (যেমন টুনা, শার্ক) খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
কোন ধরনের মাছে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে?
ভারী ধাতু দূষিত মাছ
ভারী ধাতু, বিশেষ করে পারদ (মার্কারি), লেড, এবং আর্সেনিক, বড় আকারের সামুদ্রিক মাছে অধিক মাত্রায় পাওয়া যায়। এগুলি হল:
- টুনা মাছ: বিশেষ করে বড় আকারের টুনা যেমন বিগ আই টুনা ও বেফিন টুনাতে মার্কারির মাত্রা বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতি সপ্তাহে ১৫০ গ্রামের বেশি টুনা খেলে তার শরীরে মার্কারির মাত্রা বাড়তে পারে।
- শার্ক (হাঙর): অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার মার্কারি থাকে। আমেরিকান এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (EPA) অনুসারে, শার্ক মাছে প্রতি কিলোগ্রামে ১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত মার্কারি থাকতে পারে, যা WHO এর সুপারিশ করা সীমা থেকে অনেক বেশি।
- সোরডফিশ (টলোয়ার মাছ): উচ্চ মাত্রার মার্কারি থাকে। FDA এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৯০% সোরডফিশে সুপারিশকৃত সীমার চেয়ে বেশি মার্কারি রয়েছে।
- কিং ম্যাকারেল: এটিতেও মার্কারির পরিমাণ বেশি। নিয়মিত খেলে শরীরে মার্কারি জমা হতে পারে, যা স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- টাইলফিশ: গাল্ফ অব মেক্সিকোতে ধরা টাইলফিশে মার্কারির মাত্রা অত্যন্ত উচ্চ।
ভারী ধাতুর সঞ্চয় মানবদেহে অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এই ধাতুগুলি শরীরে সঞ্চিত হলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, লিভার ফাংশন ব্যাহত হতে পারে, এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ভারী ধাতুর দীর্ঘকালীন এক্সপোজার লিভার ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সার, এবং পেটের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশেষ করে, মার্কারি মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) অনুসারে, গর্ভবতী মহিলাদের দ্বারা উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ খাওয়া ভ্রূণের উন্নয়নে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
কেমিক্যাল দূষিত মাছ
বাংলাদেশে বিশেষ করে ফর্মালিন ও কার্বাইড মিশ্রিত মাছের সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই কেমিক্যালগুলি মাছ তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এগুলি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর:
- ফর্মালিন-যুক্ত মাছ: ফর্মালিন শরীরের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং DNA-কে পরিবর্তন করতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর ক্যান্সার রিসার্চ (IARC) ফর্মালিনকে মানুষের জন্য ক্যান্সারজনক (Group 1 carcinogen) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) ২০১৯ সালে করা একটি সমীক্ষায় পাওয়া গেছে যে ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া ৩০% মাছে ফর্মালিনের উপস্থিতি রয়েছে।
- কার্বাইড-ট্রিটেড মাছ: কার্বাইড থেকে অ্যাসিটিলিন গ্যাস নির্গত হয়, যা মাছকে আপাতদৃষ্টিতে তাজা দেখায়। কিন্তু এই কার্বাইডে আর্সেনিক ও ফসফরাস থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের মাছ খেলে লিভার ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সার এবং ব্লাডার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC) এর ২০২০ সালের একটি গবেষণা অনুসারে, দীর্ঘদিন ধরে ফর্মালিন-যুক্ত মাছ খাওয়া ফারিঙ্গিয়াল ক্যান্সার (গলার ক্যান্সার), গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার (পেটের ক্যান্সার), এবং লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
পলিক্লোরিনেটেড বাইফেনাইল (PCBs) দূষিত মাছ
PCBs হল স্থিতিশীল কৃত্রিম যৌগ যা শিল্প দূষণের মাধ্যমে পানিতে প্রবেশ করে এবং মাছের টিস্যুতে জমা হয়। বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাছে PCBs বেশি জমা হয়:
- ফার্ম-রেইজড স্যামন: বিশেষ করে যেগুলি দূষিত জলে চাষ করা হয়, সেগুলিতে PCBs-এর মাত্রা বেশি থাকতে পারে। এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সপেকটিভ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ফার্ম-রেইজড স্যামনে ওয়াইল্ড-কট স্যামনের তুলনায় ১০ গুণ বেশি PCBs থাকতে পারে।
- ক্যাটফিশ: বিশেষ করে দূষিত নদী বা জলাশয় থেকে ধরা ক্যাটফিশে PCBs-এর পরিমাণ বেশি হতে পারে।
- উচ্চ-চর্বিযুক্ত মাছ: যেমন ইল (বাঁশপাতা মাছ), ক্রোকার (পোয়া মাছ) ইত্যাদিতে PCBs সহজেই জমা হয়।
ইউরোপীয় ফুড সেফটি অথরিটি (EFSA) এর মতে, PCBs মানব শরীরে হরমোনাল ব্যাধি, প্রজনন সমস্যা, ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা, এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৬ সালে ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম (NTP) PCBs-কে মানব ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত বলে সনাক্ত করেছে, বিশেষ করে লিভার ক্যান্সার এবং নন-হজকিন লিম্ফোমার সাথে।
ডায়োক্সিন দূষিত মাছ
ডায়োক্সিনও একটি স্থিতিশীল পরিবেশগত দূষক যা শিল্প প্রক্রিয়ার বর্জ্য থেকে উৎপন্ন হয় এবং পানিতে মিশে যায়। এগুলি দীর্ঘস্থায়ী এবং মাছের টিস্যুতে জমা হয়:
- হেরিং: বিশেষ করে ব্যালটিক সাগর থেকে আসা হেরিং মাছে ডায়োক্সিনের মাত্রা বেশি থাকতে পারে।
- চাইনিজ মিডস্: যেগুলি দূষিত জলে জন্মায়, সেগুলিতে ডায়োক্সিনের মাত্রা উচ্চ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ডায়োক্সিনকে গ্রুপ ১ ক্যান্সারজনক হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। ২০১৮ সালে জার্নাল অফ টক্সিকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ডায়োক্সিন এক্সপোজার থাইরয়েড ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, এবং লিম্ফোমার ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ মাছ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, কিছু নির্দিষ্ট মাছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি হতে পারে:
- আমদানিকৃত ফ্রোজেন মাছ: বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ যেমন রূপচাঁদা, কর্বা, লইট্টা ইত্যাদি। এগুলিতে সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হতে পারে।
- শহরের কাছাকাছি নদী বা জলাশয়ের মাছ: বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্য পানি নদী ও জলাশয়কে দূষিত করে। ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীতে ধরা মাছে ভারী ধাতু ও শিল্প রাসায়নিকের মাত্রা অনেক বেশি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR) এর ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে যে বুড়িগঙ্গা নদীর পাঁচটি মাছের প্রজাতিতে (শোল, বোয়াল, আইড়, ভেটকি, এবং পাঙ্গাস) লেড, ক্যাডমিয়াম এবং ক্রোমিয়ামের মাত্রা WHO সুপারিশকৃত সীমার চেয়ে অনেক বেশি।
- রাজশাহী এলাকার কিছু মাছ: রাজশাহী এলাকার কিছু জলাশয়ে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি। এই এলাকায় ধরা মাছে আর্সেনিকের মাত্রা উচ্চ পাওয়া গেছে, যা লিভার ও কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে রাজশাহী অঞ্চলের কিছু জলাশয়ে আর্সেনিকের পরিমাণ WHO কর্তৃক নির্ধারিত সীমার ৫-৬ গুণ বেশি।
- চাষকৃত পাঙ্গাস: বাংলাদেশে চাষকৃত পাঙ্গাস মাছে অনেক সময় অতিরিক্ত ওষুধ ও হরমোন ব্যবহার করা হয়। এই হরমোন ও এন্টিবায়োটিক দীর্ঘদিন ধরে শরীরে প্রবেশ করলে হরমোনাল ব্যালেন্স নষ্ট হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নিরাপদ মাছ চিনার উপায়:
- ফর্মালিন পরীক্ষা: বাজারে ফর্মালিন ডিটেকশন কিট পাওয়া যায়, যা দিয়ে মাছে ফর্মালিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করা যায়।
- আয়ু পরীক্ষা: ফ্রেশ মাছের গিলস (ফুলকা) লাল হয়, চোখ উজ্জ্বল থাকে, এবং চাপ দিলে আঙুলের ছাপ থাকে না।
- গন্ধ পরীক্ষা: তাজা মাছের সুনির্দিষ্ট গন্ধ থাকে, রাসায়নিক গন্ধ নয়।
কীভাবে মাছ সংক্রান্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়?
মাছের উপকারিতা অনস্বীকার্য, তাই এটি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া সমাধান নয়। বরং, যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে মাছের খারাপ দিকগুলি এড়ানো যেতে পারে:
- বিশ্বাসযোগ্য সোর্স থেকে মাছ কিনুন: আস্থাভাজন দোকান বা সুপারমার্কেট থেকে মাছ কিনুন যেখানে মানের নিয়ন্ত্রণ ভালো থাকে।
- ছোট মাছ বেছে নিন: বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছে দূষক পদার্থের পরিমাণ কম থাকে। কারণ, বড় মাছগুলি বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং খাদ্য শৃঙ্খলের উচ্চস্তরে থাকে, ফলে তাদের শরীরে বেশি দূষক জমা হয়।
- স্থানীয় মিঠা পানির মাছ বেশি খান: সমুদ্রের মাছের তুলনায় স্থানীয় মিঠা পানির মাছে (যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, পাবদা) ভারী ধাতুর পরিমাণ কম থাকে, বিশেষ করে যদি সেগুলি দূষণমুক্ত এলাকা থেকে আসে।
- মাছের ত্বক ও চর্বি অপসারণ করুন: অধিকাংশ দূষক পদার্থ মাছের চর্বিতে জমা হয়। তাই, মাছের চামড়া এবং চর্বি অপসারণ করে রান্না করলে দূষক পদার্থের পরিমাণ কমে যায়।
- মাছ রান্নার পদ্ধতি: গ্রিল করা বা বেকড করার সময় মাছের চর্বি গলে যায়, যা দূষক পদার্থের মাত্রা কমায়। অতিরিক্ত তেলে ভাজা মাছ এড়িয়ে চলুন।
- বিভিন্ন ধরনের মাছ খান: একই ধরনের মাছ প্রতিদিন না খেয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছ খাওয়া উচিত। এতে কোন একটি বিশেষ দূষক পদার্থের অতিরিক্ত এক্সপোজার এড়ানো যায়।
বিশেষজ্ঞরা মতে, সপ্তাহে ২-৩ বার মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যকর, তবে গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা, এবং শিশুদের জন্য উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ (যেমন শার্ক, সোরডফিশ, কিং ম্যাকারেল, টাইলফিশ) এড়িয়ে চলা উচিত।
মাছের উপকারিতা: অন্য দিকটি
মাছের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে জানার পাশাপাশি এর উপকারিতাগুলিও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ উৎস থেকে ক্রয় করা স্বাস্থ্যকর মাছ শরীরের জন্য অনেক উপকারী:
ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্যকারী মাছ
অমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ (যেমন সালমন, ট্রাউট, স্যারডিন, হিলসা) শরীরে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা কিছু ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে:
- কোলন ক্যান্সার: আমেরিকান জার্নাল অফ এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত মাছ খাওয়া কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪০% পর্যন্ত কমাতে পারে।
- ব্রেস্ট ক্যান্সার: জার্নাল অফ দ্য ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খাওয়া ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
- প্রোস্টেট ক্যান্সার: অমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ধীর করতে সাহায্য করতে পারে।
হৃদরোগ প্রতিরোধে মাছের ভূমিকা
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (AHA) সপ্তাহে কমপক্ষে দুই বার মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, কারণ মাছের তেল হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে:
- কম ট্রাইগ্লিসারাইড: মাছের তেল রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়, যা হৃদরোগের একটি ঝুঁকি ফ্যাক্টর।
- উচ্চ রক্তচাপ কমানো: অমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
- রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ: মাছের তেল রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যে মাছের প্রভাব
গবেষণাগুলি দেখিয়েছে যে নিয়মিত মাছ খাওয়া মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী:
- ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ: অমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- ডিপ্রেশন প্রতিরোধ: মাছে থাকা DHA এবং EPA ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে।
- বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বিকাশ: গর্ভবতী মায়ের মাছ খাওয়া ভ্রূণের মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করে। তবে, উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ এড়ানো উচিত।
মাছ কেনার ও রান্নার সময় যে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত
নিরাপদে মাছ ভোগ করার জন্য নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করুন:
- তাজা মাছ চেনার উপায়:
- চোখ: উজ্জ্বল, স্পষ্ট এবং ফোলা হওয়া উচিত, ধসে যাওয়া বা ঘোলাটে না।
- গিলস (ফুলকা): গাঢ় লাল বা গোলাপী হওয়া উচিত, ধূসর বা বাদামী নয়।
- মাংস: দৃঢ় হওয়া উচিত, আঙুল দিয়ে চাপ দিলে আবার ফিরে আসা উচিত।
- গন্ধ: সামুদ্রিক বা মৃদু মিঠা গন্ধ থাকা উচিত, তীব্র গন্ধ নয়।
- ফ্রোজেন মাছ:
- সঠিক প্যাকেজিং চেক করুন, ক্ষতিগ্রস্ত প্যাকেট কিনবেন না।
- শক্ত হিমায়িত অবস্থায় থাকা উচিত, নরম হিমায়িত মাছ এড়িয়ে চলুন।
- বরফের ক্রিস্টাল বা জল জমলে এড়িয়ে চলুন, এটি বারবার গলানো-হিমায়িতের সংকেত।
- সংরক্ষণ:
- তাজা মাছ কেনার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রান্না করুন, সর্বোচ্চ ১-২ দিন ফ্রিজে রাখুন।
- ফ্রোজেন মাছ ফ্রিজারে -১৮° সেলসিয়াস বা তার নীচে সংরক্ষণ করুন।
- রান্না:
- মাছ ভালোভাবে রান্না করুন, অন্তত ৬৩° সেলসিয়াস অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পর্যন্ত।
- মাছের স্কিন এবং অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ করুন।
- গ্রিল, বেকিং বা সিদ্ধ করার পদ্ধতি ব্যবহার করুন ভাজার পরিবর্তে।
বিভিন্ন দেশের গাইডলাইন ও সুপারিশ
বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা মাছ খাওয়া সম্পর্কে নির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রদান করেছে:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO):
- সপ্তাহে ২-৩ বার মাছ খাওয়ার সুপারিশ করে।
- উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছের সীমিত সেবন করার পরামর্শ দেয়।
- গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা এবং ছোট বাচ্চাদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (AHA):
- সপ্তাহে কমপক্ষে দুইবার মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেয়।
- প্রতিবারে কমপক্ষে ৩.৫ আউন্স (প্রায় ১০০ গ্রাম) পরিমাণে খাওয়ার সুপারিশ করে।
- অমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ (স্যামন, ট্রাউট, স্যারডিন, হেরিং) বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেয়।
ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA):
- ১০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য: সপ্তাহে ২-৩ সার্ভিং (প্রতি সার্ভিং ৪ আউন্স বা প্রায় ১১৩ গ্রাম) খাওয়ার সুপারিশ করে।
- উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ (শার্ক, সোরডফিশ, কিং ম্যাকারেল, টাইলফিশ) এড়ানোর পরামর্শ দেয়।
- গর্ভবতী মহিলাদের জন্য: সপ্তাহে ২-৩ সার্ভিং কম-মার্কারি যুক্ত মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, তবে টুনা স্টেক সীমিত করতে বলে (প্রতি সপ্তাহে একবার)।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউট্রিশন কাউন্সিল (BNNC):
- সপ্তাহে কমপক্ষে ৩-৪ দিন মাছ খাওয়ার সুপারিশ করে।
- স্থানীয় ছোট মাছ (যেমন মলা, খলিশা, পুঁটি) বিশেষভাবে সুপারিশ করে, কারণ এগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং দূষণের সম্ভাবনা কম।
বিভিন্ন ধরনের মাছের সুপারিশ তালিকা (স্বাস্থ্যকর থেকে সতর্কতামূলক)
মাছের নাম | উপকারিতা | মতামত | সুপারিশ |
---|---|---|---|
রুই, কাতলা, মৃগেল | উচ্চ প্রোটিন, কম চর্বি | খাওয়া নিরাপদ | সপ্তাহে ৩-৪ বার |
ইলিশ | উচ্চ অমেগা-৩, ভিটামিন ডি | মাঝারি চর্বি, মাঝারি ঝুঁকি | সপ্তাহে ১-২ বার |
পাঙ্গাস | সস্তা প্রোটিন উৎস | চাষ পদ্ধতিতে সতর্কতা প্রয়োজন | সীমিত পরিমাণে |
ছোট মাছ (পুঁটি, মলা, খলিশা) | ক্যালসিয়াম ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ | অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর | প্রতিদিন খাওয়া যায় |
টুনা | উচ্চ প্রোটিন | মার্কারির পরিমাণ বেশি | মাসে ২-৩ বার |
সামুদ্রিক বড় মাছ | প্রোটিন সমৃদ্ধ | ভারী ধাতুর ঝুঁকি | সীমিত পরিমাণে |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন ১: কোন মাছ খেলে ক্যান্সার হয়?
উত্তর: সরাসরি কোন মাছ খেলে ক্যান্সার হয় না। বরং, দূষিত জলে বসবাসকারী কিছু মাছে দূষক পদার্থ (যেমন ভারী ধাতু, PCBs, ডায়োক্সিন) জমা হতে পারে, যা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বড় আকারের সামুদ্রিক মাছ যেমন শার্ক, কিং ম্যাকারেল, সোরডফিশ ইত্যাদিতে এই ঝুঁকি বেশি থাকে।
প্রশ্ন ২: কীভাবে বুঝব মাছে ফর্মালিন আছে?
উত্তর: ফর্মালিন-যুক্ত মাছ চিনতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
- মাছের গা থেকে অস্বাভাবিক চকচকে অথবা রাসায়নিক গন্ধ আসে।
- মাছের চোখ আনাভাবিকভাবে স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল থাকে।
- মাছের গিলস (ফুলকা) অস্বাভাবিকভাবে লাল থাকে, যেন রক্তাক্ত।
- মাছ অস্বাভাবিকভাবে শক্ত এবং আঙুল দিয়ে চাপ দিলে কোন ছাপ পড়ে না।
- মাছ দীর্ঘদিন ধরে বাইরে রাখলেও নষ্ট হয় না।
বাজারে ফর্মালিন ডিটেকশন কিট পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করে সহজেই ফর্মালিন পরীক্ষা করা যায়।
প্রশ্ন ৩: স্বাস্থ্যকর মাছ কোনগুলি?
উত্তর: স্বাস্থ্যকর মাছের মধ্যে রয়েছে:
- ছোট আকারের স্থানীয় মিঠা পানির মাছ (যেমন পুঁটি, মলা, খলিশা, টেংরা)
- রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প
- স্যামন (যদি নিরাপদ উৎস থেকে হয়)
- স্যারডিন, হেরিং (যদি দূষিত এলাকা থেকে না হয়)
- ট্রাউট
এই মাছগুলি অমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন এবং অন্যান্য আবশ্যক পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ, এবং তুলনামূলকভাবে দূষক পদার্থের পরিমাণ কম থাকে।
প্রশ্ন ৪: কতটুকু মাছ খাওয়া উচিত?
উত্তর: বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে ২-৩ বার মাছ খাওয়া উচিত, প্রতিবার প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম। তবে এটি বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা, এবং খাওয়া মাছের ধরনের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা, এবং ছোট বাচ্চাদের জন্য উচ্চ-মার্কারি যুক্ত মাছ এড়ানো উচিত।
প্রশ্ন ৫: ফ্রোজেন মাছ কি নিরাপদ?
উত্তর: হ্যাঁ, ফ্রোজেন মাছ সাধারণত নিরাপদ, যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে, ফ্রোজেন মাছ তাজা মাছের চেয়েও বেশি নিরাপদ হতে পারে, কারণ হিমায়ন প্রক্রিয়া ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি থামিয়ে দেয়। তবে, আমদানিকৃত ফ্রোজেন মাছে অতিরিক্ত প্রিজারভেটিভস থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো।
প্রশ্ন ৬: মাছ খাওয়ার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি কী?
উত্তর: মাছ খাওয়ার সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি হল:
- গ্রিল করা বা বেকিং করা (অতিরিক্ত তেল ছাড়া)
- সিদ্ধ করা বা ভাপে রান্না করা
- কম তেলে ভাপানো
- কম তেলে স্ট্যু করা